সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন নগরী দ্বারকা
দ্বারকা শব্দটি শুনলেই ভেসে ওঠে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা। একসময় ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগর বলে পরিচিত দ্বারকা হারিয়ে গিয়েছে সমুদ্রের অতল গভীরে। এখনকার দ্বারকা শহরটি গুজরাটের জামনগর জেলায় অবস্থিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে চারধাম নামে পরিচিত চার প্রধান তীর্থস্থানের একটি হল দ্বারকা। আবার সপ্তপুরী নামে পরিচিত ভারতের সাতটি প্রাচীনতম শহরের অন্যতম হল দ্বারকা। দ্বারকাকে কৃষ্ণের রাজধানী বলা হয়েছে। একারণে কৃষ্ণের অপর নাম দ্বারকাধীশ বা দ্বারকেশ্বর।
অতীতে এটিকে শুধু পৌরাণিক গল্প হিসেবে মনে করা হলেও ২০০০ সালে এই স্থানে এক প্রত্নতত্ত্বীয় অভিযানে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষের, যা সেই প্রাচীন নগরী দ্বারকাকেই নির্দেশ করে। চলুন আজকে জেনে নিই সেই প্রাচীন দ্বারকা নগরীর ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে।
পৌরাণিক দ্বারকা নগরী
পৌরাণিক নগরী দ্বারকার কথা প্রাচীন ভারত ও হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য মহাভারত সহ ভগবত গীতা, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, হরিবংশ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দ্বারকা হলো সেই প্রাচীন শহর যেখানে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণ একসময় বাস করতেন। বিভিন্ন সূত্রানুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্তমান ভারতের দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত উত্তর প্রদেশের মথুরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ভগবান কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা। পরবর্তীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেন। ফলে এ খবর শুনে কংসের শ্বশুর, মগধের রাজা জরাসন্ধ রেগে যান ও এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৭ বার মথুরা আক্রমণের পরও জরাসন্ধ মথুরা জয় করতে ব্যর্থ হন। তবে এই ১৭ বার আক্রমণে মথুরার অধিবাসী যাদবরা দুর্বল হয়ে পড়ে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন বুঝতে পারেন জরাসন্ধ আর একবার আক্রমণ করলে তারা আর তা প্রতিরোধ করতে পারবেন না, তখন তিনি তার লোকদের নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা প্রতিষ্ঠা
মথুরা ত্যাগের পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। প্রথমটির মতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গরুড়ে (কৃষ্ণের বাহন) চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সাউরাস্ট্রে আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্মাণের দেবতা ‘বিশ্বকর্মার’ সাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানান, যদি সমুদ্রের দেবতা ‘সমুদ্রদেব’ তাদেরকে কিছু জমি প্রদান করেন শুধুমাত্র তবেই এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন এবং সমুদ্রদেব খুশি হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ১২ যোজন (৭৭৩ বর্গ কি.মি.) জমি প্রদান করেন। জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।
দ্বারকা নগরীর নকশা ও বিবরণ
মহাভারত অনুযায়ী দ্বারকা ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও লেক ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোটা নগরীটি ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতো। দ্বারকা নগরী ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী ও অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলত ‘বেট-দ্বারকা’ নামেই বেশি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সাথে দ্বীপ শহরটি নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় মূল দ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত এ দুটি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বাকি জীবন এ দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি ভাল্কা তীর্থের এক বনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দুর্ঘটনাবশত এক শিকারীর তীর বিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর গোটা দ্বারকা নগরী এক বিশাল বন্যায় সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই দ্বারকা নগরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বহু শতাব্দী ধরে বহু সভ্যতার মানুষ সেই স্থানে তাদের শহর নির্মাণ করে এসেছে। বর্তমানে সেখানে যে দ্বারকা নগরী রয়েছে সেটি ঐ স্থানে এমনই ভাবে নির্মিত সপ্তম শহর। দ্বারকার মূল মন্দিরটির বর্তমান নাম দ্বারকাধীশ মন্দির।
অনেকের মতে, এই ৫ তলা মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। বর্তমানে দ্বারকা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সহ পৃথিবীর বহু দেশ থেকে মানুষ এ স্থানে বেড়াতে আসে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখানে প্রায় ৩৮,৩৮৭ জন লোকের বাস রয়েছে।
সমুদ্রের নিচের অভিযানে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন বহু প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ, যা আনুমানিক প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীরও পূর্বের।
এই আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে উপকূল জুড়ে গবেষকরা আরো কয়েকটি অনুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাস্তবেই বর্তমান দ্বারকা নগরীর সামনের সমুদ্রের নিচে প্রায় ৩৬ মিটার গভীরে রয়েছে প্রাচীন সেই নগরীর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্যে রয়েছে পাথর নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির নোঙর, ভবন ও দুর্গ তৈরিতে ব্যবহৃত নানা পাথরের ব্লক। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ধ্বংসাবশেষের সবগুলোই প্রায় পঞ্চাদশ শতাব্দীর, যা মহাভারতে বর্ণিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত সেই দ্বারকা নগরীর সাথে মিলে যায়। এটি প্রমাণ করে তৎকালীন সময়ে দ্বারকা ভারতের অন্যতম ব্যস্ত একটি বন্দর নগরী ছিল।
সূএ: Roar bangla
Tags: সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন নগরী দ্বারকা , ভগবান শ্রীকৃষ্ণ , দ্বারকা নগরী