সীতাকুণ্ডের ঐতিহ্যবাহী শিব চতুদর্শী মেলা, দেশ-বিদেশের লাখো লাখো ভক্তের আগমন
সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ ধামে তিনদিনব্যাপী শিব চতুর্দশী মেলা আগামী সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। প্রতিবছর এ মেলাকে ঘিরে দেশ-বিদেশের লাখো লাখ ভক্তের আগমন ঘটে , এবারো এমনটিই ঘটেছে। মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মেলাকে সামনে রেখে সীতাকুন্ড মেলা কমিটি ও স্রাইন কমিটি পৃথক পৃথক সাংবাদিক সম্মেলন করেছে ।
জানা গেছে,আনুমানিক তিন’শ বছরেরও আগে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ ধামে শিব চতুর্দশী মেলা শুরু হয়। প্রতিবছর এ মেলায় ভারত,নেপালসহ দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পুণ্যার্থীর আগমন হয়। এবারো একইভাবে ১৪-১৫ লাখ ভক্তের আগমন হবে বলে ধারণা। মেলা শুরু হবার আগে থেকেই ভক্তদের আগমন শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ফলে তীর্থভূমি এখন উৎসব মুখর। সংশ্লিষ্টরা জানান,শাস্ত্র মতে দেবাধিদেব মহাদেব বলেছেন কলি যুগে তিনি চন্দ্রনাথেই অবস্থান করবেন। যে ব্যক্তি চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থ দর্শন করবেন তার আর পুনর্জন্ম হবে না। এই কারণে সারা বিশ্বের হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের অনুসারীরা জীবনে একবারের জন্য হলেও চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থ দর্শনে ছুটে আসেন। সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ ধামে অসংখ্য মঠ-মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বটতলী কালী মন্দির, শনি মন্দির, প্রেমতলা মন্দির,সত্য নারায়ণ মন্দির,শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম, ব্যাসকু-, ভৈরব মন্দির,সুর্যকু-,শংকর মঠ ও মিশন, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, মোহন্ত আস্তানা,ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের সৎসঙ্গ,শ্মশান কালী মন্দির,হনুমান মন্দির,উনকোটি শিবের বাড়ি, রামকু-, লক্ষন কু-, সীতাকু-,নারায়ণ ছত্র,সীতার পাতালপুরী, দধিকু-,জ্বালামুখী কালী বাড়ি,গুরুধ্বনী,অন্নপূর্ণা মন্দির, স্বয়ংভূনাথ মন্দির,বিরূপাক্ষ মন্দির ও পাহাড় চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির। দূরাগত তীর্থ যাত্রীরা পূণ্যলাভের আশায় চন্দ্রনাথ ধামে উপরোক্ত মঠ-মন্দির দর্শন ও পূজা করেন। বিশেষত শিব চতুর্দশী তিথিতে ধর্মপ্রান হিন্দুরা ব্যাসকুন্ডে পূণ্য¯স্নান করে মূলত ভৈরব বাড়ি,শম্ভুনাথ বাড়ি, বীরুপাক্ষ ও চন্দ্রনাথ দর্শন করে দেবাধিদেব মহাদেবকে ডাবের জল ও দুধ দিয়ে ¯ স্নান করিয়ে মাথায় ফুল ও বেল পাতা দেন। পাশাপাশি অন্যান্য মঠ-মন্দির দর্শন করেন। তবে এই তিথিতে অনেকেই ব্যাসকুন্ডের পাড়ে পূর্ব পূরুষদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ,তর্পন,গয়াকু-ে পিন্ডদানসহ নানান ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন। এবার শিব চতুর্দশী তিথি শুরু হয়েছে ৪ মার্চ বিকাল ৫টা ৩৪ মিনিটে। তিথি থাকবে ৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে। তবে মেলাটি চলবে ৬ মার্চ পর্যন্ত। এছাড়া একই স্থানে ২০-২১ মার্চ দোল পূর্ণিমা মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে ৪ মার্চে শুরু হওয়া মেলার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ৬ মার্চ শেষ হলেও মেলা চলে দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত।
তিন দিনের শিব চতুর্দশী মেলাকে ঘিরে প্রতিবছর বেশ কিছু আয়োজন করে থাকে তীর্থ কমিটি ও মেলা কমিটি। মঠ-মন্দিরে পূজার্চনা ছাড়াও তীর্থভুমির মোহন্ত আস্তানায় এবার চার দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হবে। এতে দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অতিথি,মন্ত্রী,এমপি থেকে শুরু করে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।
প্রতিবছর বিশাল এ মেলাকে ঘিরে পুরো তীর্থভূমিতে অসংখ্য দোকানপাট স্থাপিত হয়। এতে ধর্মীয় বই-পুস্তক,দেব- দেবতাদের ছবি, শিশু-কিশোরদের খেলনা, নানারকম খাবারের দোকান থেকে শুরু করে বহু দোকান বসে। অসংখ্য খাবার হোটেলে নিরামিষ রান্না করে বিক্রি করা হয়। দূরাগত দর্শনার্থীরা তীর্থ দর্শন, খাওয়া দাওয়া, কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরেন। উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসবকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিবছর অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসে। কেউ তীর্থ যাত্রীদের বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহ করেন, কেউবা যাত্রীরা যেন নিরাপদে তীর্থ দর্শন করতে পারেন সে লক্ষ্যে পুরো সড়ক ও মন্দিরে দায়িত্ব পালন করেন। আবার মেলায় যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতিবছর আলোক সজ্জা, পানীয় জল প্রভৃতি সরবরাহ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও। এভাবে সবার সহযোগিতায় মেলা সুসম্পন্ন হয়।
অন্যদিকে সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হওয়া এ শিব চতুদর্শী মেলায় আগত তীর্থ যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছে সীতাকু- মেলা কমিটি। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করেছে প্রশাসন। মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সীতাকু- সার্কেল শম্পা রানী সাহা ও অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দেলওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৪০০জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া মহিলা আনসার ভিডিপি সদস্য নিয়োজিত থাকবে ৩০-৪০জন।
শিবচতুদর্শী মেলাকে ঘিরে চলবে সীতাকু- ¯্রাইন কমিটির উদ্যোগে বিশ্ব বৈদিক সম্মেলন,মহাতীর্থ পদক ও ঋষী সমাবেশ। এছাড়া শংকর মঠ ও মিশন,রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম,শ্রী শ্রী লোকনাথ বহ্মচারী সেবাশ্রম,শ্রী জগন্নাথ সেবাশ্রম,শ্বশান কালী বাড়ি,অনুকুল ও রাম ঠাকুর আশ্রম,জন্মাষ্টমী পরিষদ,গীতা শিক্ষা কমিটি,ভোলানন্দ সেবাশ্রমসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন গীতাযজ্ঞ,নাম সংকীর্ত্তন,ধর্মসভাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ চৌধুরী জানান, চন্দ্রনাথ ধামে শিব চতুর্দশী মেলা চলবে ৪-৬ মার্চ তিন দিন। এসময় কমপক্ষে ১৪-১৫ লাখ ভক্তের আগমন ঘটবে এখানে। একই স্থানে ২০-২১ মার্চ দোল পূর্ণিমা মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এসব অনুষ্ঠানে আগত ভক্তদের নিরাপত্তায় প্রশাসনের সাথে সমন্বয়ে প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে।
সীতাকু- মহাতীর্থ কমিটির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট চন্দন দাশ বলেন, মেলাকে ঘিরে পাহাড়ি পথে সিঁড়ি সংস্কার, মন্দিরে রং করা, অন্ধকার স্থানে লাইট স্থাপন, ৩’শ স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখাসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া মেলায় চারদিনব্যাপী বৈদিক সম্মেলন, ঋষি সমাবেশ, মহাতীর্থ পদক প্রদান অনুষ্ঠিত হবে।
মেলা কমিটির কার্যকরী সভাপতি সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় বলেন,ঐতিহ্যবাহী এই মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা একটি চ্যালেঞ্জ হলেও আমরা যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছি। তীর্থ যাত্রীরা নিষ্ঠার সাথে পূজা পার্বন ও তীর্থ দর্শন করে নিরাপদে ফিরে যাবেন বলে মনে করেন তিনি।