আমরা কি হিন্দু? আমাদের ধর্ম সনাতন না হিন্দু? বেদ সবাই পাঠ করতে পারবে? সনাতন ধর্মে মূর্তি পূজা আছে? সবাই কি পূজা করতে পারবে?

মূলত এই প্রশ্ন গুলা আমার এক বিধর্মী বন্ধু করেছে। আমাকে সে বলতেছে হিন্দু ধর্ম একদিন থাকবে না। আর তরা তো আসলে হিন্দু না, তদের ধর্ম গ্রন্থেও হিন্দু কোন শব্দ নেই। আর মূর্তি পুজাও তদের ধর্মে নেই। যে ধর্ম নিয়ে এত গর্ব সেই ধর্ম পালন করিস ঠিকই বাট পূজার অধিকার নেই। তদের মূলত কোন ধর্মই নেই।। লাস্ট কথাটা বলার পর একটু থামতে বললাম।
বললাম শোন, প্রথম থেকে উত্তর গুলা দেই। তোর অ্যারাবিয়ান গুষ্টি ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৭৯০ পর্যন্ত উপমহাদেশের হিন্দুদেরকে বিলুপ্ত করার জন্য বহু চেষ্টা করেছে। খুন, ধর্ষণ, জোর করে বিধর্মী করণ, জিজিয়া কর চাপিয়ে আর্থিক চাপে ফেলে ধর্মান্তকরণের চেষ্টা, কোনোটাই বাদ দেয় নি।

 

এছাড়াও অন্য ধর্ম অস্বীকার করায় খুন করেছে প্রায় ৫০ কোটি হিন্দুকে, এত প্রচেষ্টার পরও ভারতীয় উপমহাদেশে এখনো হিন্দুর সংখ্যা সব থেকে বেশি। এই ঘটনা কি এটা প্রমান করে যে, হিন্দুরা আর হিন্দু থাকবে না? পরে বললাম, এবার শুন আমরা কেন হিন্দু? – হিন্দু কোনো ধর্মের নাম নয়, এটা একটা জাতির নাম। আর, হিন্দুদের ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম। যেটা পৃথিবীর শুরু থেকে আছে আর থাকবে। ইসলাম ধর্মের বিকল্প নাম যদি মুসলমান ধর্ম হয়, তাহলে সনাতন ধর্মের বিকল্প নাম হিন্দু ধর্ম হলে অসুবিধা কোথায়? সিন্ধু প্রদেশের নাম অনুসারে সনাতন ধর্মালম্বিদের নাম হয়েছে হিন্দু, এটা ঠিক। কিন্তু নামে কি আসে যায়? কর্মই প্রাধান্য পায়।।
এবার বলি মুর্তি পূজা আছে নাকি নেই?
হিন্দু ধর্মের প্রধান গ্রন্থ ঋগ্বেদে এই ব্যাপারে কী লেখা আছে, দেখুন-
“একং সদ্বিপ্র বহুদাবদন্তি।” ঋগ্বেদ – ১/১৬৪/৪৬
এর অর্থ হলো, পরমেশ্বর এক ও একের মধ্যে বহুশক্তি।
এই বহুশক্তিই যে দেব দেবী, সেটা বলা আছে নিচের এই শ্লোকে,
“একং সত্যং বহুদা কল্পয়ন্তি।” ঋগ্বেদ – ১/১১৪/৫
এর অর্থ, দেব-দেবী, পরমেশ্বরের বিভূতি ও অনন্ত শক্তির প্রকাশ।
এবার দেখুন, হিন্দু ধর্মের সারগ্রন্থ গীতায় এ ব্যাপারে কী বলা আছে,
“যো যো যাং যাং তনুং ভক্ত শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।তস্য তস্যাচলং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম।।” গীতা-৭/২১
এর অর্থ, যে যে স্বকামী ভক্ত যে যে দেবতার স্বরূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করতে ইচ্ছুক, আমি তাদের শ্রদ্ধা সেই দেবতার প্রতি স্থির করি।
শ্রীকৃষ্ণ হলো হিন্দুধর্ম তথা সনাতন ধর্মের প্রধান পুরুষ, সে কিন্তু দেবতার বিভিন্ন রূপকে গীতায় তার বাণীর মাধ্যমে স্বীকার করে নিচ্ছে।
গীতার ৭/২২ শ্লোকে কী লেখা আছে,
“স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হিতান্।”

এর অর্থ, সেই পুরুষ শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেব বিগ্রহের পূজায় তৎপর হন এবং সেই দেবতার মাধ্যমে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্য লাভ করেন।
এখানে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, যে ব্যক্তি যে দেবতার পূজাই করুক, সে আমার দ্বারাই তার ফল লাভ করে। এখানেও দেবতাদের পূজাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
গীতার ১১/১৫ শ্লোকের বাণী, যে শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তার বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলো, সেই বিশ্বরূপে অর্জুন কী দেখেছিলো… দেখুন,
“পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সবাংস্তথাস ভূত বিশেষ সঙ্ঘান্ ।”

এর অর্থ হলো, হে দেব, আপনার দেহে আমি সমস্ত দেবতা এবং বহুভূতের সমুদায়, পদ্মের আসনে অবস্থিত ব্রহ্মা মহাদেব, সমস্ত ঋষিগণ এবং দিব্যসর্পসমূহ দেখছি।
কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শণ করতে গিয়ে অর্জুন তার মধ্যে বহুদেবতাকে দেখেছিলো। এটা কি প্রমান করে না যে, হিন্দু ধর্মে দেবতার পূজার স্বীকৃতি শ্রীকৃষ্ণ নিজে দিয়ে গেছেন বা তাদেরকে স্বীকার করে নিয়েছেন?
এবার আসি, আমার ধর্ম আমাকে পূজার অধিকার দিয়েছে কিনা?
মনুসংহিতা, যাতে হিন্দুদের জীবন-যাপন প্রণালী বিস্তারিতভাবে লেখা আছে, সেই মনুসংহিতা হিন্দুদের পূজা করার অধিকার সম্পর্কে কী বলেছে ?
মনুসংহিতায় ২৬৮৪ টি শ্লোক আছে। এর দশম অধ্যায়ের ৬৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, শুদ্ররা, যারা হিন্দু সমাজের সবচেয়ে নীচু জাতি বলে বিবেচিত, তারা- গুণ,কর্ম ও স্বভাব অনুসারে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য হতে পারে, আবার নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা না করে, শুদ্রও থেকে যেতে পারে। আবার একইভাবে, ব্রাহ্মণও – গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুসারে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্র হতে পারে। এখানে কিন্তু স্বীকার করা হলো যে, যোগ্যতা থাকলে যে কোনো শুদ্রও বেদ পাঠ করতে পারে, বেদের জ্ঞান অর্জন করে ব্রাহ্মণ হতে পারে এবং পূজা করতে পারে।
এই একই কথার সমর্থন আছে, গীতার জ্ঞানযোগ নামক চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নং শ্লোকে, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
“চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।”এর অর্থ হচ্ছে, পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমিই গুণ ও কর্মের ভাগ অনুসারে চারটি বর্ণ অর্র্থাৎ চার শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি করেছি। এই কথা এটাই প্রমাণ করে যে, জন্মসূত্রে আমাদের যে বংশের পরিচয়, সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিয়েও আমার যদি ব্রাহ্মণের মতো জ্ঞান ও গুণ না থাকে, আমি যেমন ব্রাহ্মণ হবো না, তেমনি শুদ্রের ঘরে জন্ম নিয়েও গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি ব্রাহ্মণ হতে পারি। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরেক জায়গায় অর্জুনকে বলেছেন, তুমি ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠো। কিন্তু অর্জুন তো ক্ষত্রিয়। এর মানেও হলো, যে কূলেই জন্ম হোক না কেনো, ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। আর ব্রাহ্মণ যদি হওয়া যায় বা ব্রাহ্মণ্যত্ব যদি অর্জন করা যায়, তাহলে সেই ব্যক্তি পূজা করতে পারবে না কেনো?

এখন ইতিহাস থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। শ্রীরাম চন্দ্র জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয়, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ক্ষত্রিয় বংশে হলেও লালিত পালিত হয়েছেন ঘোষ বংশে অর্থাৎ শুদ্রের ঘরে, বাল্যকালে তিনি গরুও চড়িয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দর আসল নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত, জন্মসূত্রে তিনি কায়স্থ, এটা সম্ভবত বৈশ্যের মধ্যে পড়ে, ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দের জন্ম নমঃশুদ্রেরর ঘরে। কিন্তু এরা কি এদের কর্মগুণে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠে নি? রাম ও কৃষ্ণ তো স্বয়ং ভগবান, তাই ওদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম, বিবেকানন্দ ও প্রণবানন্দের চেয়ে, আপনি আমি কি বড় হিন্দু, না বড় ব্রাহ্মণ?
মহালয়ার জন্য চণ্ডীপাঠ করে বিখ্যাত হওয়া কোলকাতার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও জন্মসূত্রে ব্র্রাহ্মণ নন, তিনি কি বেদ, চণ্ডী পাঠ করেন না? তার চেয়ে ভালো বেদ চণ্ডী পাঠ কেউ কি কোনো ব্রাহ্মণ করতে পারে? সুতরাং ইনিও জন্মসূত্রে অব্রাহ্মণ হলেও গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ।
স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং ১৮৯৭ সালে, শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মতিথিতে, কোলকাতায়, নীলাম্বর মুখার্জির বাগান বাড়িতে বেশ কয়েকজন নীচজাতির লোককে উপবীত দান করে তাদেরকে ব্রাহ্মনত্বে উন্নীত করেছিলেন।

এসব ঘটনা প্রমান করে যে, জন্ম যে ঘরেই হোক, ব্রহ্ম জ্ঞান অর্জন করে ব্রাহ্মণ হওয়া যায় এবং যদি ব্রাহ্মণ হওয়া যায়, তাহলে পূজা করতে অসুবিধা কোথায়?
তাহলে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, হিন্দুরা পূজা করার জন্য ব্রাহ্মণকে ডাকে কেনো? এর প্রথম কারণ হলো, নিজের যোগ্যতার অভাব এবং দ্বিতীয় কারণ অজ্ঞতা। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য হিন্দু সমাজে এই অজ্ঞতা কিন্তু সৃষ্টি করেছে আবার ব্রাহ্মণরাই। হিন্দু ধর্মের শুরু থেকেই হিন্দু শাস্ত্র এবং তার ব্যাখ্যার দায়িত্ব ছিলো ব্রাহ্মণদের উপর। তখন ব্রাহ্মণরা যদি বলতো, সকল হিন্দুরই বেদ পাঠ ও পূজা করার অধিকার আছে, তাহলে সমাজে ব্রাহ্মণদের যে প্রভাব প্রতিপত্তি এবং সম্মান, তা ক্ষুণ্ন হতো, কে চায় অন্ধের চোখে আলো ফুটিয়ে নিজের পথ অন্ধকার করতে ? তাই ব্রাহ্মণরা প্ল্যান করে এই অপপ্রচার চালিয়েছে যে, ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য কারো দেব পূজার বা বেদ পাঠের অধিকার নেই। আর এই অপপ্রচারজনিত অজ্ঞতার ফলেই হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুরা তা বিশ্বাস করে এসেছে এবং এখনও ৯৮% হিন্দু তাই বিশ্বাস করে।

যেসব হিন্দু এই তথ্য জানে যে, সকল হিন্দুরই দেব পূজার অধিকার আছে, দেখা যায়, তারাও পূজার সময় ব্রাহ্মণদেরকে ডেকে আনেন। কিন্তু কেনো?
এখানেই প্রশ্ন আসে যোগ্যতার। আপনি জন্মসূত্রে রাজমিস্ত্রী নন এবং সেই কাজ কখনো শিখেনও নি। তাহলে ইটের বাড়ি বানানোর সময় আপনি রাজমিস্ত্রীকে ডাকবেন, না নিজেই বাড়ি বানাবেন?
সুতরাং হিন্দু সমাজের যে প্রচলিত বিশ্বাস, ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনে বর্ণের হিন্দু বেদ বা কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে পারে না বা কোনো দেব-দেবীর পূজা করতে পারে না, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যে কোনো হিন্দুর যেমন যে কোনো ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের অধিকার আছে, তেমনি বিধিসম্মতভাবে পূজা পাঠ শিখে পূজা করারও অধিকার আছে। আমি আশা করছি, এই বিষয়টি আমার বিধর্মী বন্ধুকে বোঝাতে না পারলেও হিন্দুদেরকে বোঝাতে পেরেছি এবং আমি সেই সাথে এই প্রত্যাশাও করবো যে, যারা এই বিষয়টি জানলেন, তারা অন্য হিন্দুদেরকে বিষয়টি জানাবেন এবং হিন্দু সমাজ থেকে এই কুসংস্কার দূর করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন।
**ভুল ত্রুটি মার্জনিয়।